ad

বিশ্বের সপ্তাশ্চর্য: ইতিহাস, ঐতিহ্য, গুরুত্ব ও সাংস্কৃতিক প্রভাব



বিশ্বের সপ্তাশ্চর্য
Image Source: Pixabay

সপ্তাশ্চর্য কি?

বিশ্বের সপ্তাশ্চর্য বলতে আমরা সাতটি ঐতিহাসিক এবং স্থাপত্যের অসাধারণ নিদর্শনকে বুঝি, যা মানব সভ্যতার সৃষ্টিশীলতা এবং দক্ষতার প্রতীক। এই সপ্তাশ্চর্যগুলি প্রাচীন এবং আধুনিক সময়ে নির্মিত হয়েছে এবং প্রতিটি স্থাপনা তার নিজস্ব ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং সাংস্কৃতিক গুরুত্ব বহন করে।

এটি কিভাবে নির্বাচিত হয়?

সপ্তাশ্চর্যগুলির নির্বাচন একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। প্রাচীন সময়ে, গ্রিক ইতিহাসবিদ হেরোডোটাস এবং অন্যান্য লেখকরা বিভিন্ন স্থাপনার তালিকা তৈরি করেছিলেন। তবে আধুনিক সময়ে, ২০০৭ সালে "নিউ ৭ ওন্ডার্স" প্রকল্পের মাধ্যমে একটি নতুন তালিকা তৈরি করা হয়। এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিল বিশ্বের বিভিন্ন স্থাপনার মধ্যে থেকে সাতটি অসাধারণ স্থাপনা নির্বাচন করা। ভোটিং প্রক্রিয়ার মাধ্যমে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষ তাদের পছন্দের স্থাপনাগুলির জন্য ভোট দিতে পারেন।

কার দ্বারা নির্বাচিত হয়?

সপ্তাশ্চর্যগুলির নির্বাচন সাধারণত একটি আন্তর্জাতিক প্যানেল বা সংগঠনের দ্বারা করা হয়। ২০০৭ সালে "নিউ ৭ ওন্ডার্স" প্রকল্পের জন্য, একটি সুইস সংস্থা "নিউ ৭ ওন্ডার্স ফাউন্ডেশন" এই নির্বাচন পরিচালনা করে। তারা বিশ্বের বিভিন্ন স্থাপনার উপর গবেষণা করে এবং জনগণের ভোটের মাধ্যমে সাতটি স্থাপনা নির্বাচন করে।

১. পিরামিড অফ গিজা

ইতিহাস ও নির্মাণ

মিশরের গিজার পিরামিড, যা 'গ্রেট পিরামিড' নামেও পরিচিত, এটি বিশ্বের সপ্তাশ্চর্যের মধ্যে একমাত্র স্থাপনা যা এখনও টিকে আছে। এটি খেফরো নামক ফারাওয়ের জন্য নির্মিত হয়েছিল এবং এর নির্মাণকাল প্রায় ২৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। পিরামিডটি প্রায় ২.৩ মিলিয়ন পাথরের ব্লক দিয়ে তৈরি, যার প্রতিটির ওজন ২.৫ টন। এই পিরামিডের উচ্চতা ছিল প্রায় 146.6 মিটার, যা প্রাচীন সময়ে পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু মানবনির্মিত কাঠামো ছিল।

ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব

পিরামিডটি মিশরের প্রাচীন সভ্যতার প্রতীক। এটি মৃতদের জন্য একটি সমাধি হিসেবে ব্যবহৃত হত এবং মিশরের ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রতিফলন ঘটায়। পিরামিডের অভ্যন্তরে বিভিন্ন ধরনের চিত্রকর্ম এবং হায়ারোগ্লিফিক্স রয়েছে, যা প্রাচীন মিশরের জীবনযাত্রা এবং বিশ্বাসের চিত্র তুলে ধরে। পিরামিডের নির্মাণ প্রক্রিয়া এবং এর স্থাপত্য কৌশল আজও গবেষকদের জন্য একটি রহস্য।

২. হ্যাংগিং গার্ডেনস অফ বাবিলন

ইতিহাস ও নির্মাণ

হ্যাংগিং গার্ডেনস অফ বাবিলন, যা প্রাচীন বাবিলনের একটি কিংবদন্তি উদ্যান হিসেবে পরিচিত, এটি সম্ভবত নবুকাদনেজার দ্বিতীয়ের সময়ে নির্মিত হয়েছিল। যদিও এর সঠিক অবস্থান এবং অস্তিত্ব নিয়ে বিতর্ক রয়েছে, তবে এটি একটি অসাধারণ স্থাপত্য নিদর্শন হিসেবে বিবেচিত হয়। এই উদ্যানটি স্তরবদ্ধভাবে নির্মিত হয়েছিল, যেখানে বিভিন্ন স্তরে বিভিন্ন ধরনের গাছপালা এবং ফুলের বাগান ছিল।

ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব

এই উদ্যানটি প্রাচীন বিশ্বের একটি চমৎকার উদাহরণ, যা মানব সৃষ্টির সৌন্দর্য এবং প্রকৃতির সাথে মানুষের সম্পর্ককে তুলে ধরে। এটি প্রাচীন সভ্যতার উদ্যানবিদ্যা এবং কৃষির উন্নতির প্রতীক। হ্যাংগিং গার্ডেনসের সৌন্দর্য এবং স্থাপত্যের নৈপুণ্য আজও মানুষের কল্পনাকে আকৃষ্ট করে।

৩. স্ট্যাচু অফ জিউস

ইতিহাস ও নির্মাণ

স্ট্যাচু অফ জিউস, যা গ্রীসের অলিম্পিয়ায় অবস্থিত ছিল, এটি প্রাচীন গ্রীক শিল্পের একটি অসাধারণ নিদর্শন। এটি প্রায় 435 খ্রিস্টপূর্বাব্দে নির্মিত হয়েছিল এবং এটি জিউসের একটি বিশাল মূর্তি ছিল, যা সোনার এবং হাতির দাঁতের তৈরি। মূর্তিটি প্রায় 12 মিটার উচ্চ ছিল এবং এটি অলিম্পিয়ার মন্দিরের কেন্দ্রে স্থাপন করা হয়েছিল।

ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব

এই মূর্তিটি গ্রীক ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রতীক এবং অলিম্পিক গেমসের সাথে সম্পর্কিত। এটি গ্রীক শিল্পের উৎকর্ষতা এবং ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের গুরুত্বকে তুলে ধরে। জিউসের মূর্তিটি প্রাচীন গ্রীসের ধর্মীয় জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল এবং এটি দর্শকদের মধ্যে গভীর শ্রদ্ধা এবং awe সৃষ্টি করত।

৪. টেম্পল অফ আর্টেমিস

ইতিহাস ও নির্মাণ

টেম্পল অফ আর্টেমিস, যা এফেসাসে অবস্থিত, এটি প্রাচীন গ্রীসের একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্দির। এটি আর্টেমিস দেবীর উদ্দেশ্যে নির্মিত হয়েছিল এবং এর নির্মাণকাল প্রায় 550 খ্রিস্টপূর্বাব্দ। এই মন্দিরটি 127টি কলাম দ্বারা সমর্থিত ছিল, প্রতিটি কলাম ছিল 18 মিটার উচ্চ।

ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব

এই মন্দিরটি প্রাচীন গ্রীক স্থাপত্যের একটি চমৎকার উদাহরণ এবং এটি ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের কেন্দ্রবিন্দু ছিল। এটি প্রাচীন গ্রীসের ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। মন্দিরের অভ্যন্তরে আর্টেমিসের বিভিন্ন চিত্র এবং মূর্তি ছিল, যা দেবীর প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা এবং ভক্তির প্রতিফলন ঘটায়। এই মন্দিরটি প্রাচীন বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ এবং সুন্দর স্থাপনা হিসেবে বিবেচিত হয়।

৫. মাউসোলিয়াম অফ হালিকারনাসাস

ইতিহাস ও নির্মাণ

মাউসোলিয়াম অফ হালিকারনাসাস, যা বর্তমান তুরস্কের বড্রাম শহরে অবস্থিত, এটি মাউসোলাস নামক এক শাসকের সমাধি। এটি প্রায় 350 খ্রিস্টপূর্বাব্দে নির্মিত হয়েছিল এবং এর উচ্চতা ছিল প্রায় 45 মিটার। এই সমাধিটি তিনটি স্তরে নির্মিত ছিল, যেখানে প্রতিটি স্তর অলঙ্কৃত ছিল বিভিন্ন ধরনের ভাস্কর্য এবং শিল্পকর্ম দ্বারা।

ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব

এই সমাধিটি স্থাপত্যের একটি অসাধারণ উদাহরণ এবং এটি প্রাচীন বিশ্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। এটি স্থাপত্যের ইতিহাসে 'মাউসোলিয়াম' শব্দটির উৎপত্তি ঘটায়, যা পরবর্তীতে সমাধির জন্য ব্যবহৃত হয়। মাউসোলিয়ামের নকশা এবং অলঙ্করণ প্রাচীন স্থাপত্যের উৎকর্ষতা এবং শিল্পের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা প্রকাশ করে। এটি প্রাচীন সভ্যতার স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে আজও গুরুত্বপূর্ণ।

৬. কলোসাস অফ রোডস

ইতিহাস ও নির্মাণ

কলোসাস অফ রোডস, যা প্রাচীন গ্রীসের রোডস দ্বীপে অবস্থিত ছিল, এটি একটি বিশাল ব্রোঞ্জের মূর্তি ছিল যা সূর্য দেবতা হেলিয়াসকে প্রতিনিধিত্ব করত। এটি প্রায় 280 খ্রিস্টপূর্বাব্দে নির্মিত হয়েছিল এবং এর উচ্চতা ছিল প্রায় 33 মিটার। এই মূর্তিটি রোডসের প্রবেশপথে স্থাপন করা হয়েছিল, যা সমুদ্রযাত্রার জন্য একটি নির্দেশক হিসেবে কাজ করত।

ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব

এই মূর্তিটি রোডসের স্বাধীনতার প্রতীক এবং এটি সমুদ্রযাত্রার জন্য একটি নির্দেশক হিসেবে কাজ করত। কলোসাসের নির্মাণ প্রাচীন গ্রীক স্থাপত্যের উদাহরণ এবং শিল্পের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা প্রকাশ করে। এটি প্রাচীন গ্রীসের সাংস্কৃতিক জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল এবং এটি দর্শকদের মধ্যে গভীর প্রভাব ফেলত।

৭. লাইটহাউস অফ আলেকজান্দ্রিয়া

ইতিহাস ও নির্মাণ

লাইটহাউস অফ আলেকজান্দ্রিয়া, যা ফারোস লাইটহাউস নামেও পরিচিত, এটি প্রাচীন মিশরের আলেকজান্দ্রিয়া শহরে অবস্থিত ছিল। এটি প্রায় 280 খ্রিস্টপূর্বাব্দে নির্মিত হয়েছিল এবং এর উচ্চতা ছিল প্রায় 100 মিটার। এই লাইটহাউসটি তিন টি স্তরে নির্মিত ছিল, যার শীর্ষে একটি আলোকবর্তিকা ছিল যা সমুদ্রযাত্রীদের জন্য নির্দেশক হিসেবে কাজ করত।

ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব

এই লাইটহাউসটি সমুদ্রযাত্রার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশক ছিল এবং এটি প্রাচীন বিশ্বের একটি প্রযুক্তিগত চমক। এটি স্থাপত্যের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে এবং আলেকজান্দ্রিয়ার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতীক। লাইটহাউসের নকশা এবং নির্মাণ প্রক্রিয়া প্রাচীন প্রযুক্তির উৎকর্ষতা এবং মানুষের উদ্ভাবনী ক্ষমতার পরিচয় দেয়।

উপসংহার

বিশ্বের সপ্তাশ্চর্যগুলি মানব সভ্যতার সৃষ্টিশীলতা, দক্ষতা এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতীক। প্রতিটি স্থাপনা তার নিজস্ব ইতিহাস এবং গুরুত্ব বহন করে, যা আমাদের প্রাচীন সভ্যতার প্রতি শ্রদ্ধা জানায়। এই সপ্তাশ্চর্যগুলি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, মানবতা সবসময় নতুন কিছু সৃষ্টির জন্য চেষ্টা করে এসেছে এবং এই প্রচেষ্টা আমাদের ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই ব্লগ পোস্টের মাধ্যমে আমরা বিশ্বের সপ্তাশ্চর্যগুলোর ইতিহাস, ঐতিহ্য, গুরুত্ব ও সাংস্কৃতিক প্রভাব সম্পর্কে জানলাম। আশা করি, এই তথ্যগুলো আপনাদের জন্য উপকারী হবে এবং আপনাদের জ্ঞানের ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করবে।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

আইটি দর্পণ'র নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url
ad
ad
ad
ad